Pages

Saturday, 17 December 2016

মনের মিতা কলকাতা

 

তিলোত্তমা না হতে পারো, তবে কলকাতা তুমি অবশ্যই কল্লোলিনী !


আমাদের কাছে তুমি— রজকিনী প্রেম, যেন নিকশিত হেম। তাই ফিরে ফিরে আসি তোমার কাছে, বার বার। তুমি একটা বদভ্যাসের নাম। এক বার ধরলে ছাড়া খুব মুশকিল। তোমার ধোঁয়া-ধুলো-পটহোল— অনেক দিনের পুরনো বিরক্তিকর অভ্যাস। অথচ তোমার রোল-কাবাব-নাটক-ফুটবল-নন্দন-বইমেলা আজও প্রথম প্রেমের মতোই অবুঝ-সবুজ। সকাল বিকেল তোমায় গালাগালি না করলে ভাত হজম হয় না পোড়া পেটে। আবার সকালের খবরের কাগজে তোমার খবর না পড়লে কফির কাপে স্বাদ চলকায় না তেমন করে! মন কেমন আনচান করে। গোপন প্রেমিকের পাঠানো প্রেমপত্র পড়ার অবৈধ সুখ যেন বাকি থেকে যায়। তাই যেখানেই যাই, যেখানেই থাকি, সব সময় বুকের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে বেড়াই এক টুকরো কলকাতা। চুল বাঁধে না, টিপ পরে না, মলিন বসন, নেই কোনও আভরণ, তবু কত সুন্দর— আমার কলকাতা। নিউ ইয়র্কের জনসমুদ্রে আমার সেই কলকাতাকেই খুঁজি। তাকে জিতিয়ে দিতে দামি রেস্তোরাঁ ফেলে স্ট্রিট-ভেন্ডারের দোকান থেকে খাবার কিনে খাই গড়িয়াহাটের রোল-কর্নারের সঙ্গে তুলনা করে। কোনও শেষ বিকেলের আলোয় টেমসের পাড়ে দাঁড়িয়ে আনমনা হয়ে যাই। স্বচ্ছতোয়া টেমসের জলে ঝিকিমিকি করে অন্য আর এক পূণ্যতোয়ার ঝিলমিল স্মৃতি। এক স্রোতে ভেসে যায়, একসঙ্গে উজান বায়। সাধে কি আর চার্নক সুতানুটি-গোবিন্দপুর-কলিকাতাতে ফিদা হয়েছিলেন! যুবতী গঙ্গার মুখে-বুকে টেমসের ছায়া ছবি হয়ে ভেসেছিল যে !

সবাই থাকে কাছে কাছে
তুমি আছ বুকের মাঝে
স্বপ্নডিঙা তোমার তীরে
রাতবিরাতে নোঙর করে

তবু কলকাতা থাকে কলকাতাতেই। ছলাত ছলাত ঘোলাজল বয়ে যেতে চায় তস্য পুরাতন গঙ্গার বুকে যুগসঞ্চিত পলি ঠেলে। দূরে দ্বিতীয় হুগলি সেতু থুড়ি বিদ্যাসাগর সেতুর স্যিলুয়েট হাওড়া ব্রিজের সতীন হয়ে গিয়েছে কবেই! সরীসৃপের মতো ফ্লাইওভারগুলো ঝুলতে থাকে।

প্রাগৈতিহাসিক হলুদ ট্যাক্সি গরম নিঃশ্বাস ছাড়ে। গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়ানো বিদেশি গাড়ির কালো জানালার কাচের আড়ালে মেশিনের ঠান্ডা হাওয়ায় কৃত্রিম সম্পর্কগুলো মোবাইলে বক বক করে অন্তহীন। রাস্তার ঠিক মধ্যিখানে থামা, ভিড়ে উপচে যাওয়া বাসের দরজায় ‘রোক্‌কে, লেডিজ’ বাজনা বাজে। জ্যাম-জমাট নরক গুলজারে তারস্বরে বাজতে থাকা শব্দের নাম শব্দব্রহ্ম। ভিড়ে ঠাসা রাজপথে স্মার্ট চকচকে এসি বাসগুলো দেখে হঠাত্ই মন নস্ট্যালজিক হয়ে ওঠে ধুলিমলিন লাল রঙের দোতলা-আড়াইতলা বাসগুলোর জন্য। রাস্তা পার হওয়ার কসরত সার্কাসে ট্রাপিজের খেলাকে হার মানাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। হাইড্রান্টের জলে নৌকা হয়ে ভাসতে থাকে রাস্তার দোকানের এনামেলের বাসন, পাশেই অবিরাম বেচাকেনা চলছে— গরম পুরি-তরকারি, ফোলা ফোলা আটার রুটি, চপ-মুড়ি, রোল-মোগলাই এমনকী ঝোলভাতও। হাজার লোকের ভিড়েও দুপুরটাকে হঠাত্ একা করে দিয়ে এফএম-এ ভেসে আসে, ‘ম্যায় অওর মেরে তনহাই’... আদম আর ইভ সাবান মেখে স্নান করে নির্বিকার উন্মুক্ত আকাশের নীচে একই সঙ্গে পাশাপাশি। ফুটপাথের সংসারে পলিথিনের চাদরের আড়ালে শরীর আদিম খেলায় মাতে রাতের অন্ধকারে। সকালে উলঙ্গ শিশু হামা দেয় ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির তলায়। জীবন, তুমি কত বাঙ্ময়!

কেউ বিবাদি বাগ যায় না। সবাই ডালহৌসি যায়। তবু মিনিবাসগুলোর গায়ে লেখা থাকে বিবাদি বাগ। লালবাড়ি, লালদীঘি, লালবাজার, হাইকোর্ট, ইডেন গার্ডেন, রাজভবন, ফোর্ট উইলিয়ামস— আজও গঙ্গার হাওয়ায় ভাতঘুম দেয়। হাসপাতালে ব্ল্যাডব্যাঙ্কের দরজায় বি-নেগেটিভ রক্তের নিলাম হয়। সেই রক্ত অজানা কোনও মারণ রোগের জীবাণুকণিকা বুকে নিয়ে বেয়ে যায় কোনও মূল্যবান ধমনীতে। মৃত্যু দিন-প্রতি বেডের ভাড়া বুঝে নিতে শেখেনি এখনও। খুচরো না থাকলে অটোয় ওঠা বারণ। সময় মতো গন্তব্য-সই ট্যাক্সি পাওয়া আর লটারি পাওয়া প্রায় সমার্থক। তবুও সকাল হয় আবার পরের দিন, শহিদ মিনারের উপর ঝুঁকে থাকা ধূসর আকাশে। অন্ধকারের রহস্যময়তায় ঘেরা সন্ধ্যা নামে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের একলা পরীটিকে ঘিরে। নন্দন, অ্যাকাডেমি, রবীন্দ্রসদন আর মোহরকুঞ্জের প্রাঙ্গনে আলো-আঁধারি ঝাউয়ের নিভৃতিতে একটু ছোঁয়া, আলতো চুমুতে সাবেকি প্রেম। সাউথ নিটি, সিটি সেন্টার, মানিস্কোয়্যার— এমন আরও ডজনখানেক মলের ফুডকোর্টে আধুনিক প্রেম অচেনা ভাষায় কথা বলে। শুধু চোখের ভাষাটাই যা চিরকালীন। কেউ রাত বেচে বারোয়ারি বিছানায়। কেউ ঘুম কেনে ইনজেকশনের নিডল্-এ।

শিউলি, শরত্— কারওরই আর হাজিরা দিতে মনে থাকে না। তবু ঢ্যাং কুড়াকুড় বাজে। শারদ-সম্মান মুড়ি-মুড়কির মতো বিক্রি হয়। ‘নেই নেই কিছু নেই, তবুও তো আছে কিছু’র মধ্যে রয়েছে ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্স, মার্গ সঙ্গীতের পরম্পরা বয়ে নিয়ে চলা সমঝদার কলকাতা। উত্তর-দক্ষিণের বিভাজন ঐতিহ্য মেনে অপরিবর্তনীয়ই থাকে। মেট্রোর দরজা বন্ধ হতে চায় না। এত ভিড়, এত মানুষের মুখ, মুখোশও। বাইপাসের পাশে ধূলিশয্যায় ধাপার কপি, মুলো, বেগুন। আজকাল রাস্তার মোড়ও বিক্রি হচ্ছে না কি! ব্যাঙের ছাতার মতো ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল আর হাসপাতাল মোড়ে মোড়ে। সবচেয়ে বেশি বিক্রিত পণ্যের নাম শিক্ষা আর স্বাস্থ্য পরিষেবা। চেনা দিগন্ত হারিয়ে যেতে যেতে প্রত্যেক বার আরও একটু করে, নতুন নতুন মাথা তোলা হাইরাইজ মানচিত্রের পেছনে।

শিঙাড়া-কচুরি-জিলিপি, বড়ি-পোস্ত-পটল-কলাইশাক-কুচো মাছের বাটি চচ্চড়ি, কতবেল মাখা, মায়ের হাতের কুলের আচার, ফুচকা-চুরমুর-ঘুগনি-মোমো-এগরোল, নতুন গুড়ের রসগোল্লায় জারিত চার-পাঁচ সপ্তাহের মাপা ছুটি খতম। এয়ার ট্রাভেলের বাঁধা ওজনের চক্করে বড়জোর দু’চারখানা কবিতার বই, পুজোসংখ্যা, কিছু গানের সিডি। শুনশান রাজারহাটের চওড়া নতুন রাস্তায় টাটা সুমোয় করে ‘টিকিয়া উড়ান’ রাতদুপুরে— সুন্দর ছিমছাম নতুন টার্মিন্যাল বিল্ডিং এয়ারপোর্টে। আর এক বার পিছন ফিরে দেখা, শেষ বার, এ বারের মতো। প্রতি বছরই তো চলে যেতে হয় এক বার করে। বিরাট একটা পাখির মতো প্লেনটা ডানা ছড়িয়ে উড়ান ভরে পশ্চিমে মুখ করে। চোখের নোনা সমুদ্দুরে ঝাপসা হয়ে যেতে চায় জানালার কাচের ও পারের অন্ধকার। দূর থেকে আরও দূরে সরে যেতে থাকে অনেক নীচে তখন ঘুমিয়ে পড়া আমার সেই শহরটা।
স্বাতী মিত্র
আনন্দবাজার পত্রিকা
নিউ ইয়র্ক ২১ এপ্রিল, ২০১৫
ছবি - অর্ণব মজুমদার

--Blue Vitamin



No comments:

Post a Comment