[12/22, 10:56] : উত্তর- মধ্য কোলকাতার তিন কিলোমিটার
ব্যাসার্ধ ঘিরে একটি অঞ্চল, শিয়ালদা থেকে মানিকতলা, গড়পার থেকে গঙগাপাড়,
উনবিংশ ও বিংশ শতকের সময়কালে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বঙগসংস্কৃতির
পীঠস্থান ছিল।
ভারত পথিক রাজা রামমোহন রায় গৃহনির্মাণ করেন ও সূচনা
করেন ব্রাহ্ম আন্দোলনের এখান থেকেই, আজ যা কোলকাতা আরক্ষা বাহিনীর
উপনগরপালের কার্যালয় ও আরক্ষা বিভাগের সংগ্রহালয়। একটু এগিয়ে বিদ্যাসাগর
মশাই এর বাড়ি। খানিক পশ্চিমে এগিয়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ী, যার কথা আলাদা করে
বলার দরকার হয়না। একটু উত্তরেই জন্মভিটা স্বামী বিবেকানন্দের সিমুলিয়া
পাড়ায়। কাছেই নারীশিক্ষার পীঠস্থান বেথুন স্কুল। এগোই পূর্বদিকে, আজকের
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড গত যুগে ছিল রেললাইন, চলত আবর্জনাবাহী গাড়ি
ধাপার পথে। পরে কলিকাতার অন্যতম প্রধান পথ। দক্ষিণে এগিয়ে একপাশে বসু
বিজ্ঞান মন্দির, আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ও লেডি অবলা বসুর বাসভবন ও
বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্র। অপর পাশে ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়, বঙগকণ্যাদের
আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতিতে সর্বাত্মক উন্নতি করার লক্ষ্যে সে যুগের প্রণম্য
ব্রহ্মবিদগণ, শিবনাথ শাস্ত্রী, দুর্গামোহন দাশ, আনন্দমোহন বসু, প্রমুখ
প্রতিষ্ঠা করলেন স্কুল। গায়েগায়েই আছে রায়বাড়ি, বাংলার সংস্কৃতিতে ঠাকুর
পরিবারের পরেই যাঁদের নাম, এক এক সদস্য এক এক দিকের দিকপাল। সাহিত্যে
উপেন্দ্রকিশোর, সুবিনয়, সুকুমার, সুখলতা, পুণ্যলতা, লীলা; বিজ্ঞান সাহিত্যে
প্রমদারঞ্জন; ক্রিকেটে কুলদারঞ্জন, গণেশ ও কার্তিক বোস; মুদ্রণশৈলী,
বাণিজ্যে ও বিজ্ঞাপনে পথিকৃৎ, চলচ্চিত্র শিল্পেও অমূল্য অবদান। পাশেই
বাংলার প্রথম মূক-বধির বিদ্যালয়। দু'পা এগোলেই ফেডারেশন হল বা মিলন মন্দির,
এখানেই কবিগুরু ডাক দিয়েছিলেন বঙগভঙগ বিরোধী আন্দোলনের ১৯০৫ এ, "বাংলার
মাটি বাংলার জল....... " স্বকন্ঠে গেয়ে। লেডীস পার্ক, যা আজ সাধনা সরকার
উদ্যান, এক সময় নাম ছিল গ্রীয়ার পার্ক, বাঙালীর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের
প্রথম পাদে কংগ্রেসের তথা জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয় এখানেই। ফুটবল ও হকি
খেলার জন্যও বিখ্যাত ছিল এই মাঠ। উল্টোদিকেই বিজ্ঞান কলেজ। স্যর আশুতোষের
আহ্বানে সাড়া দিয়ে এলাকার ভূস্বামীরা দান করেছিলেন জায়গা, রাসবিহারী ঘোষ ও
তারকনাথ পালিত তাঁদের অবদানের জন্য থাকবেন চিরস্মরণীয়। বাঙালীর বিজ্ঞান
শিক্ষার প্রসারে যুগ যুগ ধরে বহন করছে আলোকবর্তিকা। বিজ্ঞান সাধক আচার্য
প্রফুল্লচন্দ্র রায় রসায়ণে গবেষণা করেছেন, শিষ্য তৈরী করেছেন, কাটিয়েছেন
তপস্বীর জীবন এখানেই। মেঘনাদ সাহার গবেষণাও এখানেই। বিশ্বখ্যাত
বিজ্ঞানমনস্বীদের পদধূলিতে ঋদ্ধ এই কলেজ। গড়পারে বেশ কিছুকাল বাস করে
গেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। নিকটেই রাজাবাজারের এক বাড়িতে কিছুদিন কাটান
শ্রীমা সারদা। ঝামাপুকুরে ছিল দাদা রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের টোল, সেখানেই
আসেন গদাধর, বাঙালীর প্রাণের ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ।
এই চৌহদ্দীতেই আছে,
কেশব চন্দ্র সেনের বাসভবন যা আজ ভিক্টোরিয়া কলেজ, মৌলালীতে ইয়ং বেঙগলের
ঋত্বিক হেনরী লুই ডিরোজিওর ভবন, যা আজ ঋত্বিক ক্লিনিক। সংস্কৃত কলেজ,
হিন্দু কলেজ (আজকের হিন্দু স্কুল), হেয়ার স্কুল এখানেই। কলেজ স্কোয়ারের
দক্ষিণ পাশে ডেভিড হেয়ার সমাধিস্থ হন।
প্রেসিডেন্সী কলেজও। স্বাধীনতার
আগের বেঙগল মেডিকেল স্কুল, শিয়ালদহের কাছে, আজ সেটি ক.রা.বী.
হাসপাতাল।ঐতিহাসিক কোলকাতা মেডিকেল কলেজ কাছেই। মেডিকেল কলেজের উল্টোদিকের
গলিতে বাস করতেন বংকিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। পাশের গলিটিও স্মরণীয়; বাঙালী
শিক্ষার্থী চিকিত্সকরা মধুসূদন গুপ্তের দেখানো পথে ওখানে করতেন
শবব্যাবচ্ছেদ,বেরোলেন সংস্কারের গন্ডী ভেঙে।
আরো কত ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ছড়িয়ে আছে এই এলাকার পথে পথে, গলিতে গলিতে, যা তাত্ক্ষনিক স্মৃতিতে আসলোনা।
[12/22,
11:00] : আমার কালকের লেখাটায় যথেষ্ট অসম্পূর্ণতা ছিল। তার অনেকটা ভরিয়ে
দিয়েছেন গৌতমবাবু। মনে পড়ে গেল বাঙালীর শরীরচর্চায় সেই সময়কার সাফল্য।
স্বদেশী আন্দোলনের আংগিকে, অনুশীলন সমিতির একটি অংগ ছিল পার্শীবাগানে,
এখনকার বিদ্যাসাগর স্ট্রিটে, পুলিন বিহারী দাসের আখড়া, যেখানে তরুন দল
গোপনে শিখত লাঠিখেলা, ছোরাখেলা, তরোয়াল খেলা। পালোয়ান গোবর গোহর পাড়া
এখানেই, গোয়াবাগানে। ব্যায়ামাচার্য বিষ্ণু চরণ ঘোষের আখড়া ও আয়রন ম্যান
নীলমণি দাশের বাড়ি সুকিয়া স্ট্রিটে।
[12/22, 11:02] :
এই অঞ্চলে পার্শীবাগান ছিল একটি বর্ধিষ্ণু পাড়া, যা আজ নানা নামে বিভক্ত
হয়ে গিয়েছে। তার একটির নামকরণ হয়েছে বিখ্যাত সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত গিরীশ
চন্দ্র বিদ্যারত্নের নামে। তিনি ছিলেন আদতে রাজপুরের মানুষ। বিদ্যাসাগর
মশাইয়ের ঘনিষ্ঠ সুহৃদ ও সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ। প্রতিদিন পায়ে হেঁটে আসতেন
কলিকাতায়। পরে পরিণত বয়সে গৃহনির্মাণ করেন। তাঁর ছেলে হরিশচন্দ্র কবিরত্নও
ছিলেন পিতৃপদানুুসারী। গিরিশ বিদ্যারত্নের প্রতিষ্ঠিত প্রেস বা সংস্কৃত
মুদ্রাযন্ত্রের নামডাক ছিল। সেই বাড়ি আজ পুণ্যস্থান কারণ শ্রীমা সারদা দেবী
কিছুদিন বাস করে যান ওখানকার কর্মচারী তাঁর এক ভাইয়ের কাছে। পাশের গলিটি
আজ পার্শীবাগান লেন - গলির মুখে একদিকে বিজ্ঞান কলেজ, অন্যপাশে বসু
বিজ্ঞান মন্দির। এই গলির জায়গায় বাস করতেন বিদ্যোতসাহী ভূস্বামী
রাসবিহারী ঘোষ। স্যার আশুতোষের অনুপ্রেরণায় নিজের বিরাট জমি তিনি দান করেন
বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য। তাই রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজের ক্যাম্পাসের
নাম রাসবিহারী প্রাংগন। আর একটি পরিবার ছিলেন এই গলির বাসিন্দা। বাংলা
শিক্ষা সংস্কৃতি জগতের দুই ঊজ্জ্বল নক্ষত্র গিরিন্দ্রশেখর বসু, সুবিখ্যাত
ভারতীয় মনোবিজ্ঞানী ও মনোরোগচিকিত্সাবিদ এবং তাঁর ভাই রাজশেখর বসু,
পরশুরাম নামে যিনি বাংলা সাহিত্যের একজন দিশারী।
[12/22,
11:03] : ধর্ম আন্দোলনেও এই এলাকা ছিল পথিকৃৎ। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের
সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা হয় কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটে, আজকের বিধান সরণিতে।
ব্রাহ্ম আন্দোলনের ঋত্বিকরা ঋদ্ধ করেছেন আমাদের এই অঞ্চল। পরবর্তীকালে
দ্বন্দ্বদীর্ণ ব্রাহ্মসমাজ কেশব সেনের নেতৃত্বে যুবদলকে নিয়ে তৈরী করল
নববিধান। তত্কালীন ঝামাপুকুর পাড়ায়, এখনকার আমহার্সট স্ট্রিটে। বিষ্ণুচরণ
ঘোষের সহোদর যোগানন্দ আমেরিকায় গিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন যোগদা মিশন, ভারতীয়
হঠযোগ ও হরিভক্তি পা রাখলো বিশ্বের দরবারে।
[12/22,
11:04] : আবার এলাম আসরে। এবার বলি ক'জন চিকিৎসকের কথা। বিশিষ্ট ব্রাহ্ম
শিক্ষাবিদ ও সমাজ সংস্কারক দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের দ্বিতীয়া পত্নী,
কাদম্বিনী, ব্যক্তিজীবনে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর শাশুড়ী ও সুকুমারের অতি
প্রিয় দিদিমা; কলিকাতা মেডিকেল কলেজে নিজ যোগ্যতায় ভর্তি হন, কিন্তু
ফাইনালে বাঙালী, তার ওপর মহিলা হওয়ার অপরাধে সাহেব পরীক্ষক কিছুতেই পাশ
করালেন না। শেষে নিজেদের চেষ্টায় বিলেত থেকে দুটি ডিগ্রী অর্জন করে দেশে
ফিরলেন প্রথম ভারতীয় মহিলা ডাক্তার হয়ে। দায়িত্ব নিলেন তত্কালীন লেডী
ডাফরিন হাসপাতালের। সেযুগে জুড়িগাড়ি চেপে উচ্চ ভিজিটে রোগী দেখতে যেতেন।
রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজের উল্টোদিকে ডা. এম. এন. চ্যাটার্জী মেমোরিয়াল আই
হসপিটাল। মন্মথ নাথ চট্টোপাধ্যায় প্রথম ভারতীয় চক্ষুশল্যবিদ। নিজের
প্রাসাদোপম বসতবাড়িটি জনকল্যাণে উত্সর্গ করে যান। পরবর্তীযুগে খ্যাতকীর্তি
ডা. বিধান চন্দ্র রায় ও ডা. নারায়ণ চন্দ্র রায় ছিলেন এই অঞ্চলেরই মানুষ।
[12/22,
11:05] : জোড়াসাঁকো অঞ্চলের আর একটি উল্লেখযোগ্য ও দর্শনীয় জায়গা হল রাজা
রাজেন্দ্র মল্লিকের বাড়ি মার্বেল প্যালেস। বাড়ি না বলে বলা উচিৎ প্রাসাদ।
সুবিশাল চৌহদ্দির ভিতরে ঢুকলে মনে হবে কোন রাজার প্রাসাদ। বাগান, ফোয়ারা
মার্বেলে মোড়া অট্টালিকা। জায়গায় জায়গায় ইউরোপীয় স্টাইলে শ্বেতপাথরের
সুদৃশ্য মূর্তি। ভেতরে চিত্রকলা সংগ্রহ। এবাড়ির বিশেষত্ব ছিল ব্যক্তি
সংগ্রহের চিড়িয়াখানা। ছোটবেলায় আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ঐ চিড়িয়াখানা দেখার। কি
না ছিল সেখানে! অসাধারণ পাখীর সংগ্রহ, কত রকমের ম্যাকাও। হরিন, এমনকি দুটো
দুষ্টু শিম্পাঞ্জীও ছিল। জানিনা চল্লিশ বছর পরে মার্বেল প্যালেস কি
অবস্থায় আছে। সবাই মিলে একবার ঘুরে এলে হয়না?
[12/22,
11:07] : উত্তর- মধ্য কোলকাতার আরেকটি উল্লেখযোগ্য এলাকা চোরবাগান,
বর্তমানে মুক্তারামবাবু স্ট্রিট, রাম মন্দির ও ততসংলগ্ন অঞ্চল। ঝামাপুকুরের
পশ্চিমে, মেছুয়াবাজারের উত্তরে ওজোড়াসাঁকোর দক্ষিণ পাশে চোরবাগান -
কাঁসারীপাড়া এলাকা। উনবিংশ শতকের প্রতিপত্তিশালী প্রামানিক ও দাঁ বাড়ি
এখানে, আজও ধুমধাম করে হেরিটেজ দুর্গাপুজো হয়। এখানেই এক মেসবাড়িতে থাকতেন
সাহিত্যিক শিব্রাম, শিবরাম চক্রবর্তী।
পূর্বপ্রান্তে ঠনঠনিয়া। বহু আগে
গংগার অববাহিকার পার্শ্ববর্তী জায়গাটির নিকটেই ছিল শ্মশান, ও চালাঘরে ছিল
এক সন্ন্যাসী প্রতিষ্ঠিত কালীমূর্তি! গঙগা পরে সরে গেলেও মন্দির খানি থেকে
যায়। পরে শ্রী শংকর ঘোষ নামে স্থানীয় বড়মানুষ নতুন করে পাকা মন্দির
প্রতিষ্ঠা করেন: ঠনঠনিয়ার কালীবাড়ি নামে যা আজ বিখ্যাত।
[12/22,
11:08] : এবার এগোই কলেজ স্ট্রিট ধরে দক্ষিন মুখ ধরে। বাঁদিকে লাহাবাড়ি
পেরিয়ে বেশ খানিক এগিয়ে প্রেসীডেন্সী কলেজের উল্টোদিকের রাস্তায় কফি হাউস,
স্বনামে সুপরিচিত। শোনা যায় এটিই ছিল কেশব চন্দ্র সেনের কলুটোলার পৈত্ক
বাসভবন।
--Somnath Chakravarti